রতনের বোনের বাড়ি যাত্রা চতুর্থ পর্ব

মানব বসতির খুঁজে রতন:

চলতি পথে রতন আধাকিলোমিটার দূরে দূরে ঢালপালা ভেঙে চিহ্ন দিয়ে দিল। যাতে করে মৃত ঢালপালা দেখে পরে বুঝতে পারে সে এ এলাকায় আগেও এসেছিল । নদীর গতিপথের উল্টোপথে এগোতে লাগল সে। সে ভাবল উল্টোপথে এগুলে হয়তো নদীর আশেপাশে গড়ে উঠা কোন বসতির সন্ধান পাওয়া যাবে ।

প্রথমদিকে সে তিন-চার ঘন্টা ভালোভাবেই সামনের দিকে এগুতে পারল। তারপর থেকেই বাধল বিপত্তি । ধিরে ধিরে বনভূমি উচু হয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল । বড় বড় পাথরের খাড়া ঢাল বাড়তে লাগল । নতুন উপদ্রব যোগ হল অদ্ভুত ধরনের পোকার বিকট শব্দ, কান একেবারে ফেঁটে যাওয়ার মতো অবস্থা । এভাবে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটেও সে কোন বসতির চিন্হমাত্র দেখতে পেল না।

অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে । একটু পর রাত হবে।কোথাও আশ্রয় নেওয়া দরকার,তাই সে পাহাড়ের ঢালে কোথায় কোন গোহার মতো জায়গা আছে কিনা দেখতে লাগল । কিন্তু অনেক খোঁজার পরও সে এমন কোন জায়গার সন্ধান পেলনা। তখন সে ভাবল বড় কোন গাছের গুঁড়িতে আশ্রয় নিবে। তাই সে বড় পুরনো গাছ খোঁজতে লাগল । সে খুঁজে পেয়েও গেল একটা পুরনো গাছ। যার গুঁড়ির অনুভূমিকভাবে অনেকদূর পর্যন্ত বৃস্তিত হওয়ায় অনাআসে এর উপরের দিকে উঠে শুয়ে থাকার মতো জায়গা আছে । দুদিকে আরও দুটি ঢাল বেরিয়ে এসে এমনভাবে ঢেকে রেখেছে যে অন্য একদিকে শুধু ঢালপালা দিয়ে মুড়ে দিলেই অনেকটা ঘরের আকৃতি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে ।

রতন ঢালপালা সংগ্রহ করে ঘরের আকৃতি তৈরি করে আরও কিছু শুকনো পাতা একত্র করে মাথার নিচে গুঁজে দেবার জন্য বালিশ তৈরি করল। এর পর রাত্রি যখন গভীর হলো, তখন রতন ঐ ঘরে শুয়ে পড়ল। শুয়ে কিছুতেই দুচোঁখে ঘুম আসতেছিল না। ভাবতেছিল কি থেকে কি হয়ে গেল। যেতে ছিলাম বোনের বাড়ি এ কোথায় এসে পৌঁছলাম শেষ পর্যন্ত। অজানা রাস্তা, ঘনবন, , পূরোই শ্বাপদসংকূল অবস্থা । রাত আরও গভীর হলে সে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল।

শেষরাতের দিকে সে বুঝতে পারল তার শরীরে গাছের উপরের দিক থেকে কোন ঘন তরল পদার্থ টুপ টুপ করে পড়ছে। প্রথমে সে বুঝতে পারল না এটি কি হতে পারে । পরে সে দেখল তরল পদার্থটি আঠালো। তখন সে আস্তেকরে একটু মুখে লাগিয়ে দেখে এটা আসলে মধু। গাছের উপরে হয়তো কোন মৌমাছির দল বাসা বানিয়েছ। কিন্তু তাই বলে মধু কেমন করে নিচের দিকে পড়বে, আপনা থেকে। সে কারন বুঝতে পারল না। এদিকে রাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত বনভূমি । ফলে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। ফলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই ।

আনুমানিক ঘন্টা দুয়েক পর চারদিকে ফরসা হতে শুরু করল। একটু পরে সূর্য উদয় হবে। চারদিকে মোটামুটি পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। সে দেখতে পেল যে গাছের উপর ইয়া বড় এক ভাল্লুক মধু খাচ্ছে মৌমাছির চাক ভেঙে । ওখান থেকেই মধু চুয়িয়ে পড়ছে। রতন জানত মধু ভাল্লুকের খুব প্রিয় । তা নিজ চোঁখে দেখতে পেল। এরপর ভাল্লুকটি মধুর চাক নিয়ে অন্য গাছের দিকে চলে গেল। রতন গাছের ঢালের বিছানা থেকে উঠে আবার চলতে শুরু করল। সামনের দিকে যতই এগোচ্ছে ততই উচু বনভূমি, ঘন জঙ্গল । এভাবে চলতে চলতে একসময় মনে হল জঙ্গল আস্তে আস্তে হালকা হচ্ছে, আর ভূমি সমতল আকৃতির মনে হচ্ছে । তার অর্থহল সে পাহাড়ি বনের চূড়ায় এসে পৌঁচেছে। এভাবে সারাদিন ঐ সমতল ভূমিতেই চলতে থাকে । তাতেও চারদিকে জনমানবশূন্য অরন্য ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এভাবে রাত পর্যন্ত এভাবে চলতে চলতে ক্নান্ত হয়ে পড়ল।

সমতল ভূমিতে থিকার জন্য প্রস্তুতি নিল রতন। সারারাত ভালোভাবেই কাটল। সকাল হলে সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। তাকে যে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। পৌঁছতে হবে জনবসতি পর্যন্ত । সে চলতে শুরু করল। সূর্য যখন মাথার উপর আসল তখন তার মনে হল সমতলভূমি ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আসছে, নিচু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে । তার মানে পাহাড়ি বনের চূঁড়া থেকে সে নিচের দিকে নামছে । সে মনে মনে আনন্দিত হল এইভেবে ঢালু যেখানে শেষ হবে সেখানে আবার সমতলভূমি পাওয়া যাবে এবং সেখানে জনবসতি পাবার সম্ভাবনা প্রবল। প্রায় আনুমানিক ঘন্টা দুই-তিন হাঁটার পর সে দূর থেকে ভেসে আসা ছাগলের ডাক শুনতে পেল। তার মানে ছাগলগুলো যদি পালিত ছাগল হয় তবে খুব কাছেই কোন জনবসতি আসে। সে তাড়াতাড়ি চলতে লাগল । একসময় সে ঢালু শেষ করে যখন সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছল তখনই দেখতে পেল লিকলিকে লম্বা তামাটে বর্ণের এক ছেলে একপাল ছাগল ছড়াচ্ছে । ছেলেটিকে দেখে পুরোপুরি জংলিও মনে হল না আবার পুরোপুরি সভ্যও মনে হলনা। কিছুটা আদিম আদিম ভাব। তবে ছাগলের চামড়া আর পাহাড়ি গাছের ছাল কেটে তৈরি করা লুঙ্গির মতো করে একটা পোশাক পড়নে। রতন ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেল। ছেলেটি রতনকে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল তারপর অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ করতে থাকে। এতে করে দলে দলে চারদিক থেকে তার মতো দেখতে আরও মানুষ এগিয়ে আসল। তাদের মধ্যে একজনের মাথায় বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি মুঁকুট পরিহিত, তারমানে সে রাজা গোছের কেউ হতে পারে।লোকগুলো রতনকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। রতন কি করবে কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলনা। সে ভাবল আকারে ইঙ্গিতে জংলি মানুষদের তার কথা বুঝাতে হবে।

রতনের বোনের বাড়ি যাত্রা

Comments

Popular posts from this blog

Protein

দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি ও নাগরিক ভাবনা

গ্রাম বাংলার লোককথা পঞ্চম পর্ব