রতনের বোনের বাড়ি যাত্রা শেষ পর্ব

রতনের লোকালয়ে ফেরা:

রতন নানারকম আকার ইঙ্গিতে তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করলেও তারা কিছুই বুজতে পারলনা। তারা আরও জোরে জোরে অপরিচিত ভাষায় চিৎকার করতে লাগল। এতে রতন কিছুটা ভয় পেলেও পরমুহূর্তে সে চিন্তা করল মাটিতে ছবি এঁকে বুঝাতে চেষ্টা করবে। মানুষ আদিকাল থেকেই ছবি আঁকা-আঁকি দিয়ে তাদের ভাবের আদানপ্রদান করে এসেছে। সে একটি গাছের ঢালের ভাঙ্গা অংশ সংগ্রহ করে তা দিয়ে মাটির মধ্যে যেখানে দেখা যাচ্ছে সে নদীর উল্টোদিক থেকে জঙ্গলময় এলাকা থেকে এসেছে। সে নদীর গতিপথ , পাহাড়ের রেখা সব এঁকে দেখাল। জঙ্গলের লোকদের মধ্যে থেকে একজন লোক এগিয়ে এসে খুব নিচু হয়ে কি যেন কতক্ষণ পরীক্ষা করল। এরপর সে মুখে হাসি ফুটিয়ে অদ্ভুত ভাষায় রাজাকে কি যেন বুঝাল। তাতে রাজাও তার কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন । তারমানে তারা বুঝতে পেরেছে রতন পাহাড়ের ওপাড়ের জঙ্গল থেকে পথ ভুল করে এখানে চলে এসেছে । রাজা হাত উচু করে রতন কে কাছে ডাকলেল। কাছে ডেকে তাকে পুরাতন কাঠের গুড়ির তৈরি আসনে বসতে বললেন । আসের পাশের যারা ছিল রাজা তাদেরকে কিছু একটা বলতে বাঁশের গুড়ির অংশ দিয়ে তৈরি করা পাত্রে দুধের মত দেখতে কিছু একটা তরল পদার্থ নিয়ে এসে রতনকে দিল। রতন প্রথমে খেতে ইতস্তত করলে তখন জঙ্গলের লোকদের মধ্যে থেকে একজন অন্য একটি পাত্র থেকে পান করতে লাগল আর ইশারায় বুঝাল এটা আসলে ছাগলের দুধ। রতন এমনিতেই অনেক ক্লান্ত ছিল তাই কোন কিছু চিন্তা না করে বাঁশের পাত্র থেকে দুধ খেয়ে নিল। এরপর মাতব্বর গোছের একজন লোক তার কাছে এসে আকার ইঙ্গিতে জানতে চাইল সে এখন কি করতে চায় ।রতন তখন আবার মাটিতে ছবি এঁকে তার যাত্রা পথ বুঝিয়ে দিল। আর সে যে তার যাত্রা পথ ধরে লোকালয়ে ফিরে যেতে চায় তাও এঁকে দেখাল।

আসলে রতন যে জনবসতিতে পৌঁছেছিল তা ফরফরাং অধিবাসীদের এলাকা। ফরফরাংরা জাতি হিসেবে পরিশ্রমী ছাগল ও বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশুপালন ও অল্প সল্প কিছু শস্যদি আবাদ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তারা নিজেদেরকে তথাকথিত সভ্য লোকালয়ের কাছে থেকে দূরে রাখতেই পছন্দ করে। তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় জাতি। কেউ ভুল করে তাদের সীমানায় চলে আসলে তাদেরকে আদর আপ্যায়নের কমতি করেনা। রতনকেও তারা বিভিন্ন রকম পুড়া মাংস আর পুড়া রুটি দিয়ে আপ্যায়ন করল।

আপ্যায়ন পর্ব শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নেমে গেল। তখন তারা রতনকে নিয়ে তাদের বসতবাড়ির দিকে গেল। বসতবাড়ি বলতে পাহাড়ের যে ঢাল থাকে তা কেটে ভেতরের দিকে বিভিন্ন কাঠ দিয়ে ঘর তৈরি করে একপাশে জংলি বাঁশ আর পাতা দিয়ে দরজা তৈরি করে। রতনকে এরকম এক ঘরে থাকতে দেওয়া হল। রাত্রি বাড়ার সাথে সাথে রতন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল। অনেক সকালে রতনের ঘুম ভেঙ্গে গেল । তখন মাত্র সূর্য উঠার আগের মুহূর্ত। সে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে গেল। সে এটা দেখে অবাক হল যে সব লোকজন ইতিমধ্যে উঠে গেছে, আর যে যার পশুর পাল নিয়ে বনের মাঠের মধ্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । রতন এটা বুঝতে পারল এরা খুব পরিশ্রমী জাতী। রতন রাজার কাছে গিয়ে মাটিতে ছবি এঁকে বুঝাল যে সে তার লোকলয়ে ফিরে যেতে চায় । রাজা তার কথায় সম্মতি দিলেন । দুজন লোককে ডেকে পাঠালেন আর কি যেন বললেল। তারাশলোহার বড় বড় কুঠার জাতীয় কিছু একটা নিয়ে বনের দিকে চলে গেল। দুপুরের পর দেখা গেল তারা আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ইয়া বড় বড় কাঠের গুড়ি নিয়ে ফিরছে। দেখে মনে হল কোন নৌকা তৈরি করা হবে। রতন তখন মাতব্বর গোছের লোকটির কাছে গিয়ে ইশারায় বলল এগুলো দিয়ে কি হবে। লোকটি মাটিতে নৌকা এঁকে দেখাল, আর এর সাথে নদীর কোন গতিপথে গেলে সে তার বসতির কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে তাও এঁকে দেখাল ।

এরপরের সাতদিন ধরে রতন জঙ্গলের লোকদের সাথেই থাকল। এই সাতদিনে নৌকা বানানো হয়ে গেল। তাতে মাস্তুল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে,বাঁশ আর বনের পাতা দিয়ে ঘরের মতো ছাউনিও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে । এরপর সবাই মিলে রতনের নৌকাটি নদীর কাছে নিয়ে গেল। রতনকে নৌকায় তুলে দিয়ে সাথে পনের দিন খাওয়ার মত পর্যাপ্ত পরিমাণ রুটি আর মাংস দিয়ে দিল। রতন সবার কাছে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করল।

দশদিন দশরাত নৌকা চলার পর এগারতম দিনে দূরে বন্দরের তটরেখা দৃশ্যমান হল। সে নৌকার গতি বাড়িয়ে দিল। তিন ঘণ্টা পর সে তার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের একটা বন্দরে এসে পৌঁছল । এলাকাটি তার কাছে পরিচিত । তখন সে নৌকা থেকে নেমে গেল। এরপর কাছের বাজারে গিয়ে লোকজনকে তার দুর্দশার কথা বলতে তারা তাকে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। লোকজন তাকে কিছু টাকা দিল আর একটা ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করে দিল যার মাধ্যমে সে সহজেই তার এলাকায় চলে যেতে পারে । এভাবে সারাদিন ঘোড়ার গাড়িতে চলল সে। সন্ধ্যার সময় তার এলাকার প্রায় কাছে এসে পৌছল। রাতে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিল সে । ভোর হতেই আবার চলতে শুরু করল। দুপুর পর্যন্ত চলে সে তার বোনের বাড়ির কাছের বাজারে পৌছল। এদিকে রতনের জামাইবাবু তখন বাজারেই ছিলেন। তিনি ভাবতে পারেননি রতনকে এমন জঙ্গলের পোশাকে দেখতে পাবেন। তিনি রতনকে সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেলেন। রতনের বোন রতনকে পেয়ে মহাখুশি। আদর আপ্যায়ন চলল পুরোদমে । এভাবেই শেষ হল রতনের বোনের বাড়ি যাত্রার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার এক অধ্যায়ের ।

লেখকের কথা:
গল্পটি আসলে সম্পূর্ণ কাল্পনিক ।গল্পটি মূলত শিশু কিশোর যারা রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনী পছন্দ করে তাদের কথা মাথায় রেখেই লিখা হয়েছে।

Link for All part:
  1. First part
  2. 2nd part
  3. 3rd part
  4. 4th part
  5. last part
রতনের বোনের বাড়ি যাত্রা
রতনের বোনের বাড়ি যাত্রা

Comments

Popular posts from this blog

Protein

দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি ও নাগরিক ভাবনা

গ্রাম বাংলার লোককথা পঞ্চম পর্ব